মোহাম্মদ সাজ্জাদউদ্দিন:সকল মানুষ অভাব দূর করার জন্য চেষ্টা করে। তবে উপযুক্ত শিক্ষা না থাকলে অভাব দূর করা সম্ভব নয়। তাই সকলের জন্য শিক্ষা লাগবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা, অন্তবর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন আজ (১৪ মে ২০২৫) বুধবার দুপুর ২ টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে চবি ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের সভাপতিত্বে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস. এম. এ. ফায়েজ, স্বাগত বক্তব্য রাখেন চবি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন চবি প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস চবির সমাবর্তী শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “তোমরা সফলভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছো। এখন জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এ অধ্যায়েও তোমাদের সফল হতে হবে। বহু বছর পরে ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে পেরে এবং তোমাদের সাথে দেখা করতে পেরে আমি আনন্দিত।”
বিশ্ববরেণ্য এ শিক্ষক আরও বলেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতার সময়ে উৎসাহ সহকারে দায়িত্ব পালন করতেছিলাম। এ সময়ে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ হলো। মানুষের কষ্ট দেখে মনে খুব কষ্ট পেলাম। আমি ভাবলাম, সারা দেশের দুর্ভিক্ষ দূর করতে পারবো না, তবে জোবরার কিছু মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারি। এ ভাবনা থেকেই শুরু হলো আমার জীবনের আরেক অধ্যায়। আমি শিক্ষক থেকে ছাত্র হয়ে গেলাম। জোবরার মহিলাদের থেকে অনেক কিছু শিখলাম। পাঁচ টাকা, দশ টাকা মানুষকে এতো আনন্দ দিতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারিনি। গ্রামের সাধারণ মানুষকে লেখা শিখাতে গিয়ে নিজেরাই শিখলাম অনেক কিছু।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আমরা বলতে শুরু করলাম, ঋণ মানুষের মানবিক অধিকার। দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবো। আমরা এ ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং সফল হই। আমাদের প্রবর্তিত নতুন অর্থনৈতিক মডেল জোবরার অর্থনীতি ব্যবসায়ের অর্থনীতি নয়, বরং মানুষের অর্থনীতি। যে শিক্ষা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায় না, তা আমাদেরকে ধ্বংস করবে। তাই নতুন শিক্ষাপ্রাপ্তদের থেকে আবিস্কার করার প্রবণতা আয়ত্ত করতে হবে, নতুন নতুন ধারণা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।”
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আমি জোবরার কাছে কৃতজ্ঞ। এ কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া যাবে, তা ভাবিনি। চবি গৌরব করতে পারে যে, আমি চবির পাশেই অবস্থিত জোবরা গ্রামের সাধারণ মহিলাদের ছাত্র ছিলাম। এজন্য চবি গর্ব করতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়েছে চবি অর্থনীতি বিভাগে। গ্রামীণ ব্যাংকও নোবেল পেয়েছে। এ দুটি নোবেল পুরস্কারের জন্য চবি অবশ্যই গর্ব করতে পারে।
পরিশেষে তিনি শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের পাঠদান ও গবেষণার পদ্ধতি মনের মতো করে সাজাতে হবে। বিশ্ব গঠন করা আমাদের হাতে। আমাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজেদের ভাবনা অনুযায়ী বিশ্বটাকে গড়তে হবে।
আজকের সমাবর্তনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, দলীয় রাজনীতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যেন কলুষিত না করে। রাজনীতি করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি করুন। শিক্ষকতায় থাকলে শিক্ষার্থীদের বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করুন। জাতির প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পালন করছি কিনা তা নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করুন। শিক্ষার উন্নয়নে আপনাদের যে কোনো প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আসবেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের ত্যাগ ভুলে গেলে চলবে না। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বপ্ন পূরণে উদারভাবে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ও ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস. এম. এ. ফায়েজ বলেন, শিক্ষার্থীদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমাদের এ অর্জনকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বমানের নাগরিক তৈরির জন্য উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সবাই মিলে এ দেশকে গড়তে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও সমাবর্তন সভাপতি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন , আমরা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র বিমোচন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের জন্য নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ডি.লিট. ডিগ্রি দিতে পেরে আনন্দিত।
তিনি শিক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নানা কারণে বর্তমানে শিক্ষার মান দুর্বল হয়েছে। সকলের মনে রাখা দরকার যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনীতি করার জায়গা নয়। এখানে শিক্ষাই আসল বিষয়। লেজুড়বৃত্তিক দলীয় রাজনীতির কারণে শিক্ষা ধ্বংস হচ্ছে। অনেক বিভাগে সময় মতো ক্লাস ও পরীক্ষা হয় না। আমরা এ অবস্থার পরিবর্তন চাই। আমরা চাই, মেধার ভিত্তিতে যোগ্যতা অনুযায়ী কেউ চাকরি পাক। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আদর্শ শিক্ষক থাকলেও দুঃখের বিষয় হলো, কেউ কেউ শিক্ষকতার চেয়ে রাজনৈতিক কাজে অধিক মনোযোগী। তারা ঠিক মতো ক্লাস নেন না।
তিনি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে আক্ষেপ করে বলেন, উন্নত দেশে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া আবেদন করতে পারেন না। আর বাংলাদেশে মাস্টার্স পাশ করে শুধু ভাইবা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়। কখনো কখনো আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমেও শিক্ষক নিয়োগ হয়। আমরা এ জাতীয় অপরাধের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছি এবং এবং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক পরিবর্তন এনেছ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান বলেন , আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা উপহার দিতে হলে শুধু দৃঢ় ইচ্ছা ও কঠোর পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সসহ সর্বক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন, বৈষম্য দূরীকরণ